গল্পের নাম:প্রতিচ্ছবি
বালিশে মুখ চেপে কাঁদছে রানু। রাত গভীর হয়েছে। এইরাতে শব্দ করে কাঁদাটা বড্ড বেমানান। আশপাশের মানুষের কানে গেলে সমস্যা আছে। সকালে উঠে একশোটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা পাশেই সাজ্জাদ ঘুমুচ্ছে। সকালেই তার অফিস। রানুর কান্নার আওয়াজে যদি ঘুম ভাঙে তো শোয়া থেকে উঠে আরেকদফা পিটাবে ওকে।
সারারাত ধরে ঘুম হয়নি রানুর। গতরাত কেটেছে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে, ফ্লোরে বসে আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে। ওয়াশরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে সে। সচরাচর সাজ্জাদ তার গালে বা গলায় মারে না। শরীরের যতটুক অংশ ঢেকে থাকে ততটুকু অংশেই মনমতো মারধোর করে। তবু মাঝেসাঝে হাতে বা গলার আশপাশে ভুলবশত আঘাত লেগে গেলে সেটাকে মুচকি হেসে আদরের চিহ্ন বলে কাটিয়ে দেয় রানু৷ আজও ঠিক তাই করবে। চুলের মুঠিতে ধরতে যেয়ে কানের পাশে সাজ্জাদের নখের আঁচড় পড়েছে তিনটা। রান্নাঘরে এসেই যখন বড়ভাবী দেখবে তখন তো টিপ্পনী কেঁটে ঠিক জিজ্ঞেস করবে
- কি রে! আদর তো জম্পেশ হয়েছে দেখা যায়।
লোকসম্মুখে স্বামী তার ফেরেশতা সমতূল্য। স্বামীর কড়া নির্দেশ এই ফেরেশতা নামক পদ থেকে যেনো কখনোই তাকে সরানোর চেষ্টা না করা হয়। স্বামীর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে রানু। না পালন করে উপায় নেই। কে বিশ্বাস করবে ওর কথা? কেও না। সাজ্জাদ সবার কাছে একজন মানবরূপী ফেরেশতা। আত্মীয় -স্বজনদের মাঝে সাজ্জাদকে অতুলনীয় পুরুষের উদাহরন হিসেবে পেশ করা হয়। অন্যান্য জা গুলো স্বামীর সাথে ঝগড়া লাগলেই খোঁটা দেয়,
- সাজ্জাদকে দেখে কিছু শিখতে পারো না? দেখো বউকে কেমন যত্ন করে? কত আদর করে? বউকে চোখে হারায় সে। আর তুমি!
তাদের খোঁটা শুনে নীরবে হাসে রানু। মানুষ বড্ড বিচিত্র! সবাই বাহির দেখেই খুশি। অন্তরালের খবর কেও জানে না। জানতেও চায় না। কেও বিশ্বাস করবে না ওকে। কেও না। এমনকি নিজের বাপের বাড়ির মানুষও না। একদিন, শুধু একটাদিন ভাইকে ফোন করে বলেছিলো,
- শুভ, তোর দুলাভাই আমাকে মারে।
বেশ দৃড় কন্ঠে শুভ প্রত্যুত্তরে বলেছিলো,
- অসম্ভব। দুলাভাই মারতেই পারে না। আর যদি মেরেও থাকে তাহলে নিশ্চিত তুই বড় কোনো ঘাপলা করেছিস।
রানুর জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষটি ছিলো শুভ। রানুর বহু সুখ দুঃখের গোপন আলাপ জানে এই মানুষটা। অথচ সেই শুভই সেদিন বোনকে অবিশ্বাস করেছিলো। এরপর থেকে কখনো কারো সামনে সাজ্জাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নিয়ে দাঁড়ায়নি রানু৷ আর বাবা! সে তো সাজ্জাদের প্রশংসা করতে করতে মুখে ফেনা তোলার উপক্রম। বারবার তার মুখে একটা কথাই শোনা যায়,
- আমার মেয়ে জীবনে কোনো পূন্য করেছিলো৷ তাইতো অমন হীরের টুকরো ছেলে পেয়েছে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রানু। সবকিছুর একটা সীমা থাকা উচিত। দিন যাচ্ছে সেই সীমা অতিক্রম করছে সাজ্জাদ। এভাবে আর হচ্ছে না৷ মুক্তি চায় সে, নিত্যদিনের অত্যাচার আর অত্যাচারের চিহ্ন দুষ্টু হাসির আড়ালে লুকিয়ে রাখার নাটক থেকে।
ফজরের নামাজ শেষে তাসবিহ্ জপছিলেন রানুর মা রাবেয়া৷ এত সকালে কলিংবেলের শব্দ পেয়ে বেশ কৌতুহলী হয়ে উঠেছেন তিনি। তাসবিহ্ জপতে জপতে এগিয়ে গেলেন বাসার সদর দরজার কাছে। দরজা খুলতেই খানিকটা অবাক হলেন রাবেয়া। রানু এসেছে। কিন্তু এত সকালে! কেনো?
- কি রে তুই?
- সরো দেখি, জায়গা দাও।
দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন রাবেয়া। বাসার ভিতরে ঢুকে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো রানু। পিছনে পিছনে গেলো রাবেয়া। মেয়ের পাশে বসতেই নজর গেলো হাতের কালো দাগের দিকে। মেয়ের পুরো শরীরে আরেকদফা চোখ বুলালেন তিনি৷ কানের পাশে নখের আঁচড় আর ডানহাতের মধ্যম আঙুলটা খানিকটা ফোলা দেখা যাচ্ছে। রাবেয়া জানে এই আঘাতের আড়ালের খবর। অনেক আগে থেকেই তার জানা। মেয়ে কখনো তাকে কিছু বলেনি। তাই তিনিও আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করেননি। মেয়ে বড় হয়েছে। নিজেরটা নিজে বুঝার মত জ্ঞান হয়েছে৷ সে যদি নিজের ব্যাক্তিগত জীবন সামাল দিতে পারে তো দিক না। সমস্যা কোথায়? তাছাড়া স্বামীর হাতে মারধোর খাওয়াটা তার কাছে জীবনেরই অংশ মনে হয়। জীবনের বাইশটা বছর নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে ২-৩ দিন মার খেয়েছেন স্বামীর হাতে। কারনে-অকারনে মার খেয়েছেন। আবার চুপচাপ সেগুলো হজমও করেছেন। কোনোদিন তিনি টু শব্দ করে কাঁদেননি। স্বামী তার ফেরেশতা সমতূল্য। সবাই তো তাই জানে। এই পদ থেকে স্বামীকে সরানোর কোনো প্রকার ষড়যন্ত্র করা যাবে না। এমনটাই নির্দেশ ছিলো আকরামের। সেই নির্দেশ পালন করেছেন রাবেয়া। অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। রানুর বিয়ে হওয়ার পর থেকে মারধোরের পর্ব চুকিয়েছেন আকরাম সাহেব। তবে এতে কিছু আসে যায় না রাবেয়ার। মার খেতে খেতে গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। এখন আর মারলেও তেমন গায়ে লাগে না তার।
জানালার পর্দাগুলো আটকে দিয়ে মেয়েকে বললেন,
- তোকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ঘুমা রানু।
-মা,,,,,,
-হুম?
- জিজ্ঞেস করবে না আমি এত সকালে এখানে কেনো?
- আমি জানি।
- কি জানো?
- তুই যা বলতে চাচ্ছিস।
- কিভাবে জানো?
- নিজের প্রতিচ্ছবিকে নিজে চিনবো না তা কি হয়? তোর গায়ের দাগগুলো যে আমার বহুদিনের চেনা।
চোখে পানি ছলছল করছে রাবেয়ার। এই মূহূর্ত্বে জগতটাকে বড্ড বিদঘুটে লাগছে রানুর। সত্যিই অন্তরালের খবর কেও জানে না। জানতেও চায় না৷ সে নিজেও কখনো জানে নি। জানতেও চায়নি। বাহিরটা দেখেই সব বুঝে নিয়েছে। মায়ের চোখে আর চোখ রাখতে পারছে না রানু৷ বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে।
নামাজের পর হাঁটাহাঁটি করে চায়ের দোকানে বসে আড্ডাবাজি শেষে পাক্কা দুইঘন্টা পর বাসায় ফিরেন আকরাম সাহেব। আজও তাই হয়েছে। দরজার বাইরে মেয়ের জুতো দেখে ঘরে ঢুকেই রাবেয়াকে জিজ্ঞেস করলেন,
- রানু এসেছে?
- হ্যাঁ।
- জামাইও এসেছে নাকি?
- হ্যাঁ এসেছে।
- এত সকালে এলো যে?
- ঐ রানু ঝগড়া করে চলে এসেছিলো। তাই ওকে নিতে এসেছে।
- রানু একটা পাগল। এমন ভালো মানুষের সাথে রাগ করে নাকি কেও?
রাবেয়া প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে পা বাড়ালো রান্নাঘরে। চায়ের কাপ নিয়ে আকরাম সাহেব চলে গেলেন নিজ রুমের বারান্দায়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনোযোগ সহকারে পেপার পড়ছিলেন তিনি। হঠাৎ কারো ব্যাথায় কোঁকিয়ে উঠার শব্দে মনযোগে ব্যাঘাত ঘটলো তার৷ আওয়াজটা রানুর গলার মত লাগলো। শব্দটা একবারই পাওয়া গেছে। আর কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না৷ মনের ভুল ভেবে আবার মনোযোগ দিলেন পত্রিকায়। এবার খুব ধীর শব্দে কথা ভেসে আসছে পাশের ঘরের জানালা থেকে।
- ******* তোর দুঃসাহস দেখে অবাক হচ্ছি।
ফের মনোযোগ নষ্ট হলো আকরাম সাহেবের। গালিটা কানে বাজছে বেশ। এবার পুরো মনোযোগ ঢেলে দিলেন পাশের ঘরের দেয়ালের পাশটাতে।
- যা, তোর বাপকে যেয়ে বল আমি তোকে মারি। দেখিস তোর বাপ বিশ্বাস করে কিনা।
- কারো বিশ্বাসের দরকার নেই। আমার পথ আমি একাই চলবো।
- ঐ***** নতুন একটা জুটিয়েছিস? আমাকে দিয়ে পোষায় না?
- মুখের ভাষা ঠিক করো। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ কারনে আমাকে তুমি মারো। দোষ না থাকলেও মারো৷ যে লোক আরেকজনের ঝাল আমাকে পিটিয়ে মেটায় তার সাথে বাস করা সম্ভব না।
- বউ কি আমার দশ বারোটা রে? ফ্রাস্ট্রেশনে ভুগলে কি করবো আমি? আরো দশ বারোটা থাকলে নাহয় ওগুলার উপর ঝাল মিটাতাম।
- আমাকে কি বিয়ে করেছো ফ্রাস্ট্রেশন মিটানোর জন্য?
- বউ হয়েছিস কেনো তাহলে?
- আমাকে পিটিয়ে মানুষের সামনে ভালো সেজে থাকো না? তোমার গায়ের উপর বমি করতে ইচ্ছে হয় আমার।
- তো কি চাস তুই? সবার সামনে আমার কথা বলবি? যা, বল। তোকে জন্ম দিছে তোর বাপ, সেই বাপ তোর কথা বিশ্বাস করে কিনা দেখ গিয়ে। তোর বাপ আমাকে ফেরেশতা মানে। তুই যা খুশি বল তোর বাপ জীবনেও মানবে না৷ এখন আমি যেয়ে বলি তুই পরকীয়া করিস ঠিকই মেনে নিবে। দেখবি তুই? দেখবি?
আকরামের সাহেবের হাতে থাকা চায়ের কাপটা কাঁপছে। সাজ্জাদের মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবিটা দেখে বড্ড কষ্ট হচ্ছে আজ। একদিন কর্মফল ভুগতে হবে সেটা তো মনেই ছিলো না তার৷ অতীতগুলো স্মৃতির দোড়গোড়ায় ভীড় জমাচ্ছে। রাবেয়ার গায়ের আঘাতের চিহ্নগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে।