গল্পের নাম:অধিকার
সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে উঠার ইচ্ছে না হলেও বাধ্য হয়ে উঠতে হলো শ্বাশুড়ি মার জন্য।উঠে ওনার রুমে গিয়ে ইনসুলিন টা দিয়ে আবার রুমে ফিরে এলো।d
সায়নী তখন ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।ঠিক সে সময় সাত বছরের ছেলেটা এসে বললো, মা টিচার্স হোমওয়ার্ক দিয়েছে।দেখোতো অংকগুলো ঠিকঠাক করেছি কিনা।
অনেকটা অনিচ্ছা সত্তেও ছেলের হোমওয়ার্ক চেক করে দিয়ে তারপর ওয়াশরুমে যাওয়ার সুযোগ পেলো সে।ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে যেই শরীর টা বিছানায় ছেড়ে দেবে ভাবল, তখনই শ্বশুর মশাই এসে আবার নতুন অফার করে বসলেন।
ওনি অনেকটা সংকোচ ঝেড়ে হেসে বললেন, বউমা,কষ্ট করে এক কাপ চা করে এনে দেবে।তোমাকে বলার ইচ্ছে ছিলোনা জানো।কিন্তু কি করব বলো তোমার শ্বাশুড়ি মা যে কোনদিন আমাকে রান্নাঘরের চুলার দ্বারে কাছে ঘেষতে দেইনি ভয়ে।তাই চুলাও জালতে জানি না।নিজেও চা করতে পারিনা।তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে বলতে হলো মা।
সায়নী আবার রান্নাঘরে শ্বশুরের জন্য চা তৈরি করে লাইব্রেরি ঘরে চা-টা দিয়ে রুমে ফিরে এলো।
তারপর যা একটু জিরিয়ে নেওয়ার সময় মিললো তার। আজ অফিসে শরীরের ওপর বেশ দখল গিয়েছে সায়নীর।প্রজেক্টের কাজ,বসের সঙ্গে মিটিং আবার মিটিং শেষে বসের সঙ্গে এদিক ওদিক ছুটোছুটি। সারাদিনের ক্লান্তিকর পরিশ্রমের কথাগুলো ভাবতে চোখে রাজ্যের ঘুম পেয়েছিল সায়নীর।
একটা সময় আমীরের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙলো তার।ঘড়ি দেখে সময় রাত সাড়ে আটটা। পাশের মসজিদ থেকে ইমামের কন্ঠে নামাজের কেরাতের আওয়াজ ভেসে আসছে ।সায়নী তড়িঘড়ি করে ওঠে বসে পড়ল।
বাসার অনেক কাজ এখনো বাকি।তার মধ্যে রাতের রান্নাটাও সারেনি।বাসার লোকজন খাবে কি? অফিস থেকে ফিরে স্ত্রী কে ঘুমুতে দেখে আমীর তাই রেগে গিয়েছে।সে রুক্ষ কঠিন স্বরে বলল,চাকরি আমিও করিনা বুঝি।নারী হয়েও অল্প খেটে এতো টায়ার্ড হলে কি চলে?
তুমি নাহয় না খেয়ে ঘুমিয়ে শরীরে রোগ বাধিয়ে টাকা খরচ করে চিকিৎসা করাবে কিন্তু বাড়ির লোকজনকেও কি না খাওয়ায়ে উপোস রেখে অসুখে ভোগাবে ?রান্না না করে ঘুমাচ্ছ কেন বল।
স্বামীর এমন তীক্ষ্ণ কথায় সায়নীর মনটা ভারী হয়ে এলো।নারী হয়ে চাকরি করছে বলে কি পুরুষের মতো সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ক্লান্তিবোধ করার অধিকার তার একেবারে নেই? পুরুষ যেমন সকাল থেকে সন্ধ্যা অফিসে খেটে এসে বাড়ি ফিরে স্ত্রীর সেবায় আয়েশি বিশ্রামে আরাম করে তেমনি কি একজন নারীর ইচ্ছে থাকতে পারেনা? অফিস শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে স্বামীর কোমল ভালোবাসার আদর-যত্নের ছোঁয়ায় নিজের ক্লান্তি দূর করতে। সে তো সে অধিকার সবসময় চায় না।তবে মাঝেমধ্যে এরকম প্রচন্ড ক্লান্তি নিয়ে যখন ঘরে ফিরে ঘরের কোন কাজে হাত বাড়ানোর শক্তি থাকেনা তখন তো খুব চায়।পরিবারের কেউ তার উপর সর্বোচ্চ ভালোবাসাটা প্রয়োগ করুক।কেউ তাকে ঘরের কাজে সাহায্য করুক।নারী বলে সে কাজের রোবট মনে না করে কেউ একজন তাকে মানুষ মনে করুক।
এসব ভাবতে ভাবতে সায়নীর আঁখি জোড়া ঘনঘন কেঁপে উঠলো।
বরের দিকে এক ফলক তাকিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরের দিকে ছুটল।তবে পিছন থেকে আমীরের ডাকে আবার থমকে দাঁড়ালো। আমীর বলল,
আগে ডাইনিং এ চলো,সকালের অপরিস্কার রেখে যাওয়া ডাইনিংটা এখনো কেউ পরিস্কার করেনি।যাও আগে সেটা পরিস্কার করে দিয়ে এসো।
সায়নী বাধ্য রোবটের মতো সেদিকে ছুটল।আমীরও গেলো পিছনে পিছনে।
তবে ডাইনিং এ গিয়ে অবাক হয়ে থমকে দাঁড়াল সায়নী।শ্বাশুড়ি মা , শ্বশুর মশাই এবং তাদের ছেলেটা টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসে আছেন।
শ্বাশুড়ি মা তাঁকে দেখতে পেয়ে একগাল হেসে বললেন, উঠলে বউমা।ক্লান্ত হয়ে তুমি ঘুমুচ্ছিলে বলে দীর্ঘ সময়ের পর মা-ছেলে মিলে রাঁধলাম।তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো,তারপর একসঙ্গে খাব।
আমির পিছন থেকে একগাল হেসে বললো, দুঃখিত বাবু, এভাবে একটু বেশি না বকে আদর করে ডাকলে তুমি খেতে উঠতেনা বলে বাধ্য হয়ে কঠোর হয়েছিলাম।
তবে এখন উঠে পড়েছ যখন এভাবে হাবলার মতন দাড়িয়ে থেকো না প্লীজ। বেচেলর জীবনের দীর্ঘ সময়ের পর মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘন্ট রেঁধেছি,তোমার সঙ্গে একসাথে খাবো বলে।তাড়াতাড়ি যাও, ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে এসো।
লোকগুলোর এমন শান্ত কোমল আচরণে সায়নীর শরীরের সারাদিনের খারাপ লাগার রেশটা পুরোপুরি কোথায় হারিয়ে গেলো।রুমে গিয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আবার খেতে চলে এলো।
শ্বাশুড়ি মা তখন মাছের একটা মাথা প্লেটে তুলে দিয়ে বললো, বউমা, রোজ রোজ খেটে এসে তুমি আবার আমাদের রেঁধে খাওয়াও।নিজে তো ভালো কিছু কোনদিন খাওনা।তুমি কি ভুলে গেলে সেদিনের কথাটা,যেদিন আমাদের ঘরে ঘরকন্না হিসেবে প্রথম পা রেখেছিলে। আমি তোমার বাবা কে কথা দিয়ে বলেছিলাম,তোমাকে ঘরের বউ হিসেবে নয় মেয়ে হিসেবেই আগলে রাখব সারাজীবন।
তোমার বাবাকে দেওয়া কথাটা কতটুকু রাখতে পারলাম জানি না। তুমি আমার ঘরে ঘরকন্না হয়ে আসার পর থেকে আমিও কেমন জানি অলস হয়ে প্রতিটি বিষয়ে তোমার উপর নির্ভর হয়ে গেলাম।সংসারের কোন কাজ করতে গেলে মনে হয় সংসার সামলাতে তো তুমি এসে গেছো,আমার রান্নাঘরে যাওয়া কি দরকার।
এখন বুঝতে পেরেছি মা,সংসারের পুরো হাল তোমার একার উপর চাপিয়ে দিয়ে ভুল করেছি।তাই আজ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি,আমীরের ভালোলাগা খারাপলাগার উপর এতকাল যেভাবে নজর রেখেছি তোমার বেলায়ও ঠিক ততোটাই রাখব।
সায়নীর অভিমানী চোখজোড়া এবার সরব হয়ে ধরা দিলো ভালোবাসার কাছে।পাশাপাশি চেয়ারে বসা আমির তখন হাত ধরে বললেন, সুখ-দুঃখ সমভাবে ভাগাভাগি করে আজীবন সঙ্গে থেকে দায়িত্ব পালন করব বলেই তো এই হাত ধরে ছিলাম সায়নী।তবে নিজের ভালো লাগা খারাপ লাগা গুলো প্রকাশ না করে রোবটের মতন খেটে গেলে কিভাবে তোমাকে বুঝব বল। মাঝেমধ্যে নিজের ভিতর টা প্রকাশ করিও সায়নী।ভয় পেয়ো না, তোমাকে সেদিন অনুষ্ঠান করে রোজ রোজ আঘাত করার উদ্দেশ্যে ঘরে আনিনি,ঘরে তুলেছি একসাথে দু'জন সুখ-দুঃখের কয়েকটা যুগ পার করব বলে।নিঃসন্দেহে আমি যেমন আমার সব দুঃখ তোমাকে শেয়ার করি মনের ভিতর পুষিয়ে রাখি না তুমিও তেমন পোষে রেখোনা।প্রকাশ করো,কথা দিচ্ছি তোমার সব কথা শুনবো এবং সব কথা পালন করার আপ্রাণ চেষ্টা করব।
সায়নী নিরব।কথা বলার শক্তি নেই,এতোদিন সংসারের মানুষগুলোর বিরুদ্ধে মনেমনে যে বিরোধের নিম্নচাপ গড়ে তুলেছিল,আজ তাদের কিছু মর্মস্পর্শী কথায় সে ভারী নিম্নচাপটা বিধ্বস্ত হয়ে তাদের প্রতি মায়া ভালোবাসা টা কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। মনটা কেমন জানি একেবারে হালকা হয়ে এলো।সায়নী প্রাণভরে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া চাইতে চাইতে বললো,এ সংসারের জন্য সে শুধু কয়েক যুগ কেন,হাজার হাজার যুগ একা লড়ে হলেও সবাইকে নিয়ে পরম সুখে থাকতে চায়। সৃষ্টিকর্তা তাকে কিছু দিক বা না দিক, মানুষগুলোর জন্য সে অধিকার টা হলেও দিক।