গল্পের নাম:আবার দেখা
আরাফের কথা বাবাকে বলতেই বাবা বললেন, 'তোমার ধারণা আছে এ দেশে বেকারের সংখ্যা কত? তুমি যেভাবে বলছো তাতে মনে হচ্ছে চাকুরি মামা বাড়ির মোয়া, চাইলাম আর অমনি পেয়ে গেলাম।'
আমি মাথা নিচু করে অনুনয়ের স্বরে বললাম, 'বাবা, আরাফ অনেক মেধাবী এবং পরিশ্রমী। ও ঠিক একটা চাকুরি পেয়ে যাবে দেখো।'
বাবা ব্যঙ্গ হাসি হেসে বললেন, 'তোমার কী মনে হয় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো বেকাররা সবাই মেধাহীন? সবাই কী অলস? শোনো মা, চাকুরি পাওয়া এত্ত সোজা হলে দেশে দিন দিন এতো বেকারের সংখ্যা বাড়তো না।'
বাবার কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাব ঠিক তখন বাবা বলে উঠলেন, 'ওসব চিন্তা ছাড়ো। আগামী সপ্তাহে জুনায়েদের পরিবার আসবে তোমাকে দেখতে। তুমি সেটা নিয়ে বরং চিন্তা করো। তাদের যেন তোমাকে দেখে অপছন্দ না হয় সেইভাবে প্রস্তুতি নাও।'
রুমে এসে বসতেই আরাফের ফোনকল, 'বাবা কী বললেন?'
আমি চুপ করে রইলাম। আরাফ আবার প্রশ্ন করলো, 'তৃষ্ণা। বাবা কী বললেন?'
'বাবাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারলাম না।' নিরাশ কন্ঠে বললাম।
আরাফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, 'তাহলে ছেলেপক্ষ আসছে এটা চূড়ান্ত, তাইতো?'
অসহায় হয়ে বললাম, 'এছাড়া আর কোনো অপশন তো নেই আরাফ।'
'কবে যে একটা চাকুরি হবে! বলতে পারো তৃষ্ণা? সবার কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি আমি। জীবনের এই পর্যায়ে এসে নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে খুব।' করুণ গলায় কথাগুলো বললো আরাফ।
চোখ জোড়া ভিজে উঠলো। সান্ত্বনা দিয়ে কিছু একটা বলতে যাব ঠিক তখন মা এসে বসলো পাশে। আরাফের কথার কোনো জবাব না দিয়েই কলটা কেটে দিলাম।
মাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কিছু বলবে মা?'
'বাবা-মায়েরা কখনো সন্তানদের অমঙ্গল চায় না। আমরাও তোর ভালোর কথাই চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ছেলেটা খুব ভালো। ভালো একটা চাকুরি করে। ভালো বেতন, দেখতেও ভালো আর পরিবারও বেশ ভালো।'
আমি চুপ করে মায়ের কথাগুলো শুনছিলাম। মাকে বলার মতো এই মুহুর্তে আমার কাছে কোনো কথা নেই। আরাফ সম্পর্কে মাকে অনেকবার বলার পরেও মা একটুও নরম হয়নি আমাদের বিষয়ে৷
দেখলেই তো আর বিয়ে হয়ে গেলো না। এটাই এখন বড় সান্ত্বনা। এই সান্ত্বনার উপর নির্ভরশীল হয়ে কিছুটা নির্ভার হতে পারছি।
আগামীকাল পাত্রপক্ষ আসবে। আরাফ হাহাকার মিশিয়ে বললো, 'কাল তোমায় অন্য কেউ এসে দেখে যাবে। আর আমি তোমার জন্য কিচ্ছু করতে পারছি না৷ নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে।'
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, 'দেখে যাবে কিন্তু নিয়ে তো যাবে না৷ খুব শীঘ্রই সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি ধৈর্য হারিয়ো না৷'
মা ইদানীং আমায় খুব চোখে চোখে রাখছে৷ সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই মা এসে প্রস্তুত হওয়ার তাগেদা দিতে লাগলো। মেকআপ করার জন্য খুব তোরজোরও শুরু করে দিলো। বেলা বারোটার মধ্যেই পাত্রপক্ষ এসে বাসায় হাজির৷ আমি ইচ্ছে করেই মেকআপ করিনি। এমনকি মুখে কোনো ক্রিমও লাগাইনি৷ মা আমার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে রইলো। মা ঠিক যতটা চায় পাত্রপক্ষ আমাকে পছন্দ করুক৷ আমি তারথেকেও বেশি চাই, পাত্রপক্ষ আমায় অপছন্দ করুক।
পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে চুপচাপ বসলাম। সবার করা প্রশ্নের উত্তর হুম, না শব্দ উচ্চারণেই দিতে লাগলাম। বিষয়টা বাবা-মা কারোরই ভালো লাগলো না। কারণ বিষয়টা কিছুটা অভদ্রতার কাতারে পড়ছে৷
পাত্রের বড় বোনের মুখ ভর্তি মেকআপ। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, 'তুমি মেকআপ করোনি তাই না?'
আমি মাথা নেড়ে বললাম, 'হুম।'
মা আমার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে রইলো।
পাত্রের বোন হেসে উঠে বললেন, 'বাহ্! এই যুগে তো মেকআপ ছাড়া পাত্রী দেখতেই পাওয়া যায় না। আর তুমি মেকআপই করোনি। শুনে খুব ভালো লাগলো।'
আমি চুপ করে রইলাম। মা জোর করে তার মুখে হাসি এনে বললো, 'আমার মেয়ের তো মেকআপ বক্সই নাই। ও এসব একদম পছন্দ করে না। আর আমরাও চাই না মেয়ের আসল চেহারা মেকআপ দিয়ে ঢেকে রাখতে।'
আমি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। পাত্রপক্ষের লোকজন নিজেদের মধ্যে ফুসফাস করে কথা বলে জানিয়ে দিলেন, পাত্রী তাদের পছন্দ হয়েছে। এই কথা শুনে বাবা আর মায়ের মুখে হাসি ধরে না। পারলে এখনই তাদের কন্যাকে পাত্রের হাতে তুলে দেয়।
পাত্রপক্ষ বিদেয় হলো। বিয়ের তারিখ দিয়ে গেলো। হাতে খুব বেশিদিন সময় নেই। তারা যে তারিখ দিলেন বাবা-মা তাতেই রাজি হলো। আমি নিরুপায় হয়ে ভাবতে লাগলাম কী করা যায়!
আরাফ ফোন দিয়ে আমি কিছু বলার আগেই বললো, 'পাত্রপক্ষ পছন্দ করেছে তাই না?'
আমি চুপ করে রইলাম। আরাফ জিজ্ঞেস করলো, 'বিয়ের তারিখ কবে?'
চোখ বেয়ে টপটপ পানি পড়ছে। নিজেকে সামলে বললাম, 'সামনের সপ্তাহে।'
'এতো তাড়াতাড়ি?'
'আমি কী করবো আরাফ?' কান্না জড়ানো কন্ঠে বললাম।
আরাফ অসহায়ের মতো চুপ করে রইলো।
ইতিমধ্যে বাবা-মা সব আত্মীয়দেরকে ফোন করে ফেলেছেন। কাল থেকেই বিয়ের জন্য আয়োজন শুরু করবেন বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাবা।
আমি মা'কে আবার বুঝিয়ে বলতে লাগলাম। মা স্পষ্ট স্বরে বললো, 'এখন কষ্ট হবে, কিন্তু কিছুদিন গেলে সব ভুলে যাবে তুমি৷ আমরা তোমার খারাপ চাই না। মাথায় রেখো, তোমার বাবার কিন্তু দুইবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে। তোমার জন্য আমাকে যেন বিধবা হতে না হয়।'
শেষ লাইনটা মা বেশ কঠিন গলায় বললো। মাথার মধ্যে আঘাত করলো কথাটা। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে গেলো মুহূর্তেই। তাহলে আমার এখন কী করা উচিত! ভেবে পাচ্ছি না কিছুই৷
ভাবতে ভাবতে আর দেখতে দেখতে দিন চলে গেলো। চোখের নিচে গাঢ় কালো দাগ জমেছে। চোখের দিকে তাকালেই যে কেউ বুঝে ফেলবে ঘুম হয়নি বেশ কয়েক রাত। আগামীকাল গায়ে হলুদ। কিছু জরুরী কেনাকাটার বাহানা করে ছোট বোন সিন্থিয়ার সঙ্গে বাসা থেকে বের হই। আরাফের সঙ্গে হয়তো এটাই শেষ দেখা। রেস্তোরাঁয় এসে পৌঁছাতেই দেখি আরাফ আগে থেকেই বসে আছে।
আমি আর আরাফ মুখোমুখি বসে আছি। সিন্থিয়া আমাদের থেকে একটু দূরের একটা টেবিল চেয়ারে বসে আছে।
'তুমি খুব কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছো। আমি বুঝতে পারছি।'
আরাফের এই কথাটা এতক্ষণ যাবৎ নিজেকে শক্ত রাখার সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে লাগলো। খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম তবুও। টেবিলের উপর রাখা পানির বোতলের মুখটা খুলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলাম।
'আমি যদি তোমার জীবনে না থাকি তোমার যতোই কষ্ট হোক আমি জানি তুমি অস্বাভাবিক কিছুই করবে না। কিন্তু আমি যদি আমার পরিবারকে ছেড়ে আসি আর অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়, আমি নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না। আমি একটা ছেলের হাত মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছি, আমার এই কথাটা ভাবতে যতোটা খারাপ লাগবে তারথেকেও বেশি খারাপ লাগবে আমি আমার জন্মদাতা পিতা মাতাকে আজীবনের জন্য ছেড়ে এসেছি, এই কথাটা ভাবতে।'
আরাফের চোখ জোড়া ভিজে আসছে। আমার গাল বেয়ে পানি পড়ছে।
চোখের পানি মুছে বললাম, 'আমাকে ক্ষমা করতে বলব না৷ এটা সম্পূর্ণ তোমার ইচ্ছে। কিন্তু আমি আমার বাবা-মায়ের অভিশাপে থাকতে পারবো না৷'
আরাফ ভেজা চোখে হেসে বললো, 'তোমার জন্য আমার সবসময় শুভ কামনা।'
নিজেকে খুব অপরাধী লাগলো। আরাফের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, 'শেষটাতে এসে এভাবে না বলতে হবে, এটা যদি সেই প্রথমদিন বুঝতাম তাহলে সেদিন আর তোমাকে হ্যাঁ বলতাম না।'
সিন্থিয়াকে নিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে সোজা রূপসা নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়াই। নিজের সব কষ্ট নদীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা শেষে বাসায় ফিরি৷ আমাকে দেখে মা যেন প্রাণ ফিরে পেলো।
মা'কে এমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখে বললাম, 'ভয় পেও না। আমি তোমার বিধবা হওয়ার কারণ হতে চাই না।'
মা চুপ করে তাকিয়ে রইলো। বাড়ি জুড়ে বিয়ের আমেজ৷ সবার মনে আনন্দ। আমি ব্যাতীত।
তারপর কেটে গেলো বেশ কয়েক বছর। আমার কোলে এখন ফুটফুটে কন্যা তৃপ্তি৷ সংসার আর সন্তান নিয়ে আমার ব্যস্ত সময়৷ সিন্থিয়ার বিয়ের জন্য ঢাকা থেকে খুলনাতে আসা। অফিসের কাজের চাপে জুনায়েদ এখনো আসতে পারেনি৷ বিয়ের ঠিক আগেরদিন আসার কথা তার৷
ছোট ফুফু বাড়ি ভরা আত্মীয়দের সামনে হাসিতে গদগদ হয়ে বললেন, 'তৃষ্ণার জামাইয়ের থেকে তো এগিয়ে আমাদের সিন্থিয়ার জামাই৷ তার বেতন কত জানো? সে যে অফিসে চাকুরি করে সে অফিস দেখলেই তো চোখ জুড়িয়ে যায়।'
এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে আমি কাজের বাহানায় সবার মধ্যে থেকে সরে এলাম। সিন্থিয়ার হবু জামাইকে আমি দেখিনি, তার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানাও নেই। সংসারের ব্যস্ততায় দেখাদেখি পর্বে যোগদান করতে পারিনি। তবে শুনেছি বেশ ভালো পদে চাকুরি করে। সম্বন্ধটা ছোটো ফুফুই ঠিক করেছেন৷
জুনায়েদ এলো। বাবার সঙ্গে জুনায়েদের বেশ ভালো আড্ডা জমে যায়। সিন্থিয়ার হবু জামাইকে নিয়েই আড্ডা জমে গেলো দু'জনের।
গায়ে হলুদ পর্ব শেষ হয়ে বিয়ে পর্ব চলে এলো। গেটের সামনে এক ঝাঁক ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করছে বরের পথ আটকিয়ে টাকা আদায় করবে বলে। আমি বাড়ির দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তৃপ্তির কান্না থামানোর চেষ্টা করে চলছি আর বর আসার অপেক্ষা করে যাচ্ছি।
বর চলে এলে বরকে ঘিরে ধরেছে ছেলে মেয়েরা। টাকা দিয়ে বরপক্ষ বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই আমার চোখ আঁটকালো। নিজের চোখ'কে বিশ্বাস হচ্ছিলো না। এ আমি কাকে দেখছি! আরও পরিষ্কার হতেই তৃপ্তিকে কোলে নিয়ে দ্রুত নিচে নেমে এলাম।
বর এ বাড়ির লোকেদের সঙ্গে তার সঙ্গে আসা লোকেদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। বরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে জুনায়েদ। আমি গিয়ে বাবার পাশে দাঁড়াই। আমার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে চিরচেনা একটা মানুষ৷ বাবাও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন সেই মানুষটার দিকে। এই মানুষটাকেই বাবা একদিন খুব অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কারণ সেদিন তার পরিচয় ছিলো, সে একজন বেকার৷
আমার অপলক দৃষ্টি দেখে জুনায়েদ বললো, 'তৃষ্ণা তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি হলেন জামিলের অফিসের বস।'
তারপর সেই লোকটাই আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো, 'আমি আরাফ। জামিল আমার অফিসেই চাকুরি করে। আপনি নিশ্চয়ই জামিলের হবু বউয়ের বড় বোন৷'
আমি চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম। আরাফকে নিয়ে জুনায়েদ খাওয়ার টেবিলের দিকে চলে গেলো। মা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আমাদের কাছে দাঁড়ালো।
বাবার দিকে তাকিয়ে মা কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখন আমি বললাম, 'হ্যাঁ, এই সেই আরাফ।'
বাবা চুপ করে রইলেন। আমি আবার বললাম, 'কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষকে একটু সময় দিয়ে দেখতে হয়৷ তাকে তার বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উতরে ওঠার সুযোগ দিতে হয়৷ মানুষের সব দিন একরকম থাকে না বাবা।'
আরাফের দৃষ্টি থেকে আড়াল হওয়ার জন্য দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাব এমন সময় জুনায়েদ এসে বললো, 'আরাফ সাহেব তৃপ্তিকে দেখবেন৷ একটু চলো না তুমিও।'
আমি চুপ করে জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর ভীড়ের মাঝে চোখ রাখতেই দেখি আরাফ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি চাইতাম আরাফের সঙ্গে আর দেখা না হোক। 'আবার দেখা' বলে কোনো শব্দ আমাদের জীবনে না আসুক৷ অথচ আজ পরিস্থিতি!