"এমন চোরের মত উঁকি না দিয়ে, ভেতরে আসলেই তো পারেন। আমি সামান্য স্কুল মাষ্টার বাঘ ভাল্লুক নই, তাই আমাকে ভয় পাবার কোনো কারণ নেই।".
কথাটা শুনেই চমকে উঠে শ্যামলী। সে দিব্যি দেখছিলো যে লোকটা পিছন ঘুরে কাজ করছিলো। তাহলে দরজায় যে কেউ একজন উঁকি দিচ্ছে সেটা লোকটার কি পিছনেও একটা চোখ আছে নাকি? মাষ্টার মানুষ, থাকতেও পারে। অবনী বাবুর ছিলো। অবনী সেনগুপ্ত ছিলেন শ্যামলীদের স্কুলে অংকের মাষ্টার মশাই। খুবই কড়া , তবে মানুষ হিসাবে খুবই ভালো। তিনি যখন বোর্ডে অংক বুঝাতেন তখন পিছনে কে কী করছিলো দিব্যি বলে দিতেন। তাই অন্য ক্লাশে যে যাই করুক না কেন অবনী বাবুর ক্লাসে সবাই শান্ত। তবে অবসর নেওয়ার সময় পিছনে দেখার রহস্যটা সবার সামনে বলেছিলো। আর সেটা হলো মোটা ফ্রেমের চশমা। আর তাছাড়া তখন ক্লাশে খুব বেশি ছাত্র- ছাত্রী ছিলোও না তাই বুঝতে খুব একটা অসুবিধে হতো না।
.
অবনী বাবু চলে গেলেন, তার পরের বছর বর্ষাতে স্কুলটা ভেঙে গেলো। গ্রামের লোকেরাও আর মেরামতের চেষ্টা করেনি। দুই একবার সরকারী লোক এসে ঠিক করে দিবেন বলে গেছেন ঠিকই কিন্তু ঐ বলা পর্যন্তই। তারপর গ্রামের ছেলে মেয়েরা তিন ক্রোশ দূরে বিধানপুরের স্কুলে পড়তে যাওয়া শুরু করলো। আর তাছাড়া যেতও বা কয়জন? শ্যামলীর আর স্কুলের গণ্ডিটা পার হওয়া হলো না। বাবা অবশ্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা যে করেননি তা নয়, কিন্তু শ্যামলীর লেখাপড়ায় মন নেই। মন যার প্রজাপতির মত ডানা মেলে বেড়ানোতে তার কী স্কুলে মন টিকবে?তারপর কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর। এখন শ্যামলী আর ছোট্ট শ্যামলীটা নেই। এই আষাঢ়ে ষোলতে পা দিয়েছে। শরীরে যৌবন যেন ভরা নদীর পানির মতই টলটল আর উপচে পড়ছে। কিন্তু দেহের বয়স বাড়লেও মনের বয়সটা বাড়েনি, ষোল যেন কেবলই একটা সংখ্যা। এখনো যে ছেলে মেয়েদের সাথে গোল্লাছুট খেলায় মেতে থাকে। দুপুরে নদীতে সাঁতার কাটে, বর্ষা এলে বেরিয়ে পড়ে মাছ ধরতে। এর জন্য অবশ্য বাবার কাছে কম বকা খেতে হয় না তবে ঐ যে ঐটুকুই, পরে আবার যা তাই। মেয়েটা বিয়ে দিলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। এমনটাও যে কয়েকবার ভাবেনি তা বলি না, তবে ঘরটা আনবে কে? ঘটক তো বাড়িতে ঢুকতেই পারে না। বিয়ে না হওয়াতে শ্যামলী খুশি হলেও বাবার মনে শান্তি নেই। এইদিকে দিন যতই যাচ্ছে বাবার চিন্তা যেন বাড়ছে। বয়স বেড়ে চলছে, নানান লোকে নানান কথা বলবে। হয়তো মুখের সামনে বলবে না কিন্তু আড়ালে বলবে। হয়তো দেখতে দেখতে একদিন মুখের উপরও বলা শুরু করবে।
.
এইবার ঘরে ভালো ফসল এসেছে। তাই সরকারের আশায় না থেকে সবাই মিলে গ্রামের একমাত্র স্কুলটা সারিয়ে তুললো। কিন্তু স্কুল সারালেই তো সব হয় না। তার জন্য দরকার একজন মাষ্টার মশাই। আপাতত একজন দিয়েই চলুক। পরে না হয় উপরওয়ালাদের কাছে আবেদন করা যাবে। শ্যামলী বেশ কিছুদিন ধরেই শুনছিলো গ্রামের স্কুলে নতুন মাষ্টার মশাই আসবে। শুধু আসবেই না এসে তাদেরই খোলা ঘরে থাকবে। ঘরটা বাড়ির পাশেই , সারাবছর পড়েই থাকে। তো আজ দুপুরে বাড়ি এসে যখন সে শুনলো যে নতুন মাষ্টার মশাই চলে এসেছে তখন আর দেরী না করে দৌড়ে গেল খোলা ঘরের দিকে। একটা অচেনা অজানা পুরুষের ঘরে তো আর হুট করেই ঢোকা যায় না, তাই দরজায় দাড়িয়েই উঁকি দিচ্ছিলো একটু পর পর। ইচ্ছে ছিলো একবার চোখের দেখা দেখে চলে আসবে। মাষ্টার মশাইদের সাথে বেশি কথা বলা যাবে না। গতরাতে খেতে খেতে বাবা একবার বলেছে, নতুন মাষ্টার মশাই আসলে তার কাছে না হয় পড়তে বসবি। তারপর এখন যদি বাবা শোনে যে সে মাষ্টার মশাইয়ের সাথে দেখা করেছে তাহলে ঠিক পাঠিয়ে দিবে স্কুলে বই খাতা নিয়ে। আচ্ছা, এখন কী পড়ার বয়স? যেমনটা আছি তেমনই থাকলেই তো হয়। ঠিক যেমনটা ভাবা নয় তেমনটা সব সময় হয় না, অপ্রত্যাশিত ভাবে কথাটা শুনে একটু হকচকিয়েই গেল শ্যামলী। এখন তো দৌড়ে পালানোও যায় না, পাছে সত্যি সত্যিই চোর না ভেবে বসে। আর যদি ভাবে তাহলে তো আরেক ঝামেলা চেঁচামেচি করে পুরো গ্রাম মাথায় তুলবে। তার চেয়ে বরং দুইটা কথা বলে চলে যাওয়ায় ভালো। খানিকটা ভয় ভয় নিয়েই ভেতরে ঢুকলো শ্যামলী। দেখলো নতুন মাষ্টার মশাই কি সব মোটা মোটা বই সাজিয়ে রাখছে ছোট্ট আলমারিটাতে। তার আগেও যে বিষয়টা সর্বপ্রথম শ্যামলী লক্ষ্য করেছে যে মাষ্টার মশাই চশমা পরে কিনা। কারণ অবনী বাবু এই চশমা দিয়েই তো দেখতেন পিছনে। কিন্তু না, ইনি চশমা পরেন না। তবে কী সত্যি সত্যিই পিছনে চোখ আছে নাকি? প্রশ্ন করলো শ্যামলী,
.
- আচ্ছা আপনি তো পিছন ঘুরে ছিলেন, তাহলে আমি যে উঁকি দিচ্ছি সেটা দেখলেন কীভাবে? তাছাড়া আপনি তো আর অবনী বাবুর মত চশমা পড়েন না।
.
প্রশ্ন শুনেই ঘুরে দাড়ালো মাষ্টার মশাই। শ্যামলী একবার দেখেই চমকে উঠলো। বুকটা ধক করে উঠলো। কোথায় মাষ্টার মশাই, এ তো অল্প বয়সী একটা যুবক মাত্র। তাহলে কি ইনিই সেই নতুন মাষ্টার মশাই? নাহ্ একা আশা মোটেও ঠিক হয়নি।
.
- অবনী বাবু কে?
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন মাষ্টার মশাই।
.
- আমাদের অংকের মাষ্টার ছিলেন। খুব কড়া মানুষ হুহ। বললেন না তো, আমাকে দেখলেন কীভাবে?
.
কথাটা শুনে একটু হাসলেন। তারপর বললেন,
- ঐ যে আয়নাটা দেখছেন সেটাতে দেখেছি।
.
শ্যামলী দেখলো, সত্যিই তো একটা আয়না রাখা আছে ঔখানটায়। আর সেই আয়নাতে শ্যামলী নিজেও দেখতে পাচ্ছে দরজার দিকটা।
.
- ওহ্ তাই বলুন, আমি তো ভাবলাম আপনার আবার সত্যি সত্যিই পিছনে চোখ আছে।
.
- হা হা তাই বুঝি? আমি অনিন্দ্য, আপনি?
.
- শ্যামলী। যাই তবে।
.
কথাটা বলেই হনহন করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল শ্যামলী। অনেক কথা হয়েছে, আর দরকার নেই। এবার যেতে পারলেই বাঁচি। কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে দরজা অবদি তো গেল কিন্তু কী যেন মনে করে দাড়ালো। তারপর আবার পিছন ঘুরে বললো,
.
- আচ্ছা আপনি সত্যিই মাষ্টার মশাই তো?
.
-কেন আপনার এমনটা মনে হলো কেন?
.
- এমনিতেই।
.
আর এক মূহুর্ত দাড়ালো না ও। এক দৌড় দিলো বাড়ির দিকে। যাক ভাগ্য ভালো কেউ দেখেনি। লোকে দেখলে ক্ষতি নেই, বাবা দেখলেই সমস্যা। তবুও যে বিপদ কেঁটে উঠেছে তা বলা সম্ভব না। কে জানি কবে আবার বাবা এসে বলে, "এই শ্যামা অনেক হয়েছে। কাল থেকে পড়তে যাবি।"
শ্যামলীও এক রোখা মেয়ে, সে মনে মনে ঠিক করেই ফেললো যে দরকারে বিয়ে বসবে তবুও আর স্কুলে নয়।
.
অনিন্দ্য এবার এফ এ( সেই সময়ের এফ এ আর বর্তমানের উচ্চ মাধ্যমিক) পাশ দিয়ে বসেই ছিলো। বেশ কয়েক জায়গায় চাকরির আবেদন করেও কূল করে উঠতে পারেনি। কিন্তু তার এক আত্মীয় যখন এই মাষ্টারি চাকরির কথা বললো তখন আর না করেনি। মাত্র তিরিশ টাকা বেতনেই রাজি হয়ে যায়। তবে এখানে আসার আগে বেশ কয়েক জায়গায় অাবেদন করে এই ভেবে যে যদি তাদের ওখানে হয়ে যায় তখন না হয় ফিরে যাবে। যতদিন কোনো কিছু না হয় ততদিন না হয় এখানেই চলুক।
.
তারপর তিন চার তিন কেটে গেল। শ্যামলী ভুলেও আর খোলা ঘরের দিকে যায় না। গিয়ে কাজ নেই বাপু, তবে খোলা ঘরটা কেউ দখল করে নিয়েছে এটা ভাবতে খুব খারাপ লাগে ওর। কত কষ্ট করে পাড়ার সব বাচ্চাদের বুঝিয়েছে যে সেই ঘরে ভুত থাকে। এর অবশ্য একটা কারণও আছে। লুকোচুরি খেলার সময় শ্যামলী শুধু এখানেই এসে লুকাতো। বাচ্চাও ভয়ে আসতো না, তাই ধরা পড়ার ভয় নেই। কিন্তু এখন তো একটা আস্ত ভুত থাকছে। এখন নতুন জায়গা পাওয়া যাবে কোথায়? আর শুধু কী পেলেই হবে? আবার নতুন করে গল্প বানাতে হবে তারপর সেটা ওদের শুনাতে হবে। কত কাজ। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে যেই না একটা ঢিল রাস্তার ধারের বরই গাছে ছুঁড়েছে সাথে সাথে কে যেন আহ্ করে চিৎকার করে উঠলো। শ্যামলী সেইদিকে তাকাতেই এক দৌড়। সে অবশ্য দৌড়ে চলে গেল, কিন্তু অনিন্দ্য পারলো না। কপালটা হালকা কেটে গেছে। রক্ত বন্ধ করতে জায়গাটা চেপে ধরে আছে এক হাতে। দেখতে দুই একজন লোক এসে জোড়ো হলো। এমনটা কে করেছে জিজ্ঞেস করতেই সবাই বুঝলো এ কাজ শ্যামলীর ছাড়া আর কারও না।
.
এইদিকে ঘটনাটা পুরো গ্রাম রটে গেছে। শ্যামলী সারাদিন এর ওর বাড়িতে লুকিয়ে থাকলো বটে কিন্তু রাতে আর জায়গা হলো না। অবশেষে ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরে আসতেই হলো। বাবা যে খুব করেই বকা দিবে এ আর নতুন কী, তবে মারবে না। ওকে খুব ভালোবাসে। বাবা অবশ্য কিছু বললেনও না। কেবল বললো, তোমার বয়স হয়েছে, এখন আর এইসব ছেলে মানুষী মানায় না।
.
তারপর তিন চারদিন অনিন্দ্যে মাথায় একটা কাপড়ের পট্টি বেধেই স্কুলে গেল। পাশে অবশ্য শ্যামলীর সাথে অবশ্য দুইবার দেখা হয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটা কোনো কথা বলেনি, কেবল মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। এই ভাবেই বেশ কিছুদিন কেটে গেল। যদিও সে নিজেও রান্না করে, তবে মাঝে মাঝে শ্যামলীদের বাড়ি থেকে খাবার আসে। কখনো স্বয়ং শ্যামলীর বাবায় দিয়ে যেত আবার কখনো নিজে গিয়ে নিয়ে আসতে হতো।
.
সেইদিন দুপুর বেলা স্কুল থেকে ফিরে অনিন্দ্য দেখলো শ্যামলী বসে আছে দরজায়। হাতে একটা থালা। বোঝায় যাচ্ছে খাবার। অনিন্দ্য একটু অবাকই হলো। কারণ আজ তো তার নিজেরই রান্না করার কথা। তাছাড়া সে সকালে বাজারও করে রেখেছে। ভেবেছিলো স্কুল থেকে ফিরে রান্নার কাজটা সারবে।
.
- শ্যামলী তুমি?
- দেখলাম সকালে রান্না না করেই স্কুলে গেলেন। তাই খাবার নিয়ে আসলাম।
- বাড়িতে কেউ নেই?
- না, মাসি মারা গেছে। সবাই ওখানেই।আমি যাইনি।
- কেন?
- আর বলবেন না, ওখানে গেলে সবাই খালি বলে বিয়ে করো বিয়ে করো। তাই যাই না।
এইটুকু বলে একটু থামলো। তারপর অনিন্দ্যের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আবার বললো,
.
-আচ্ছা বলুন তো আমার কী এখনো বিয়ের বয়স হয়েছে? আমি তো বাচ্চা।
.
এই বার অনিন্দ্য আর হাসি আটকে রাখতে পারলো না। হেসে বললো,
- হুমম, তা ঠিক।
- বুঝেছি আপনি মজা করছেন। যাই আমি, খাবার রেখে গেলাম।
.
কথাটা বলেই উঠে দাড়ালো শ্যামলী। তারপর হন হন করে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো। অনিন্দ্য বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মেয়েটা যখন চোখের আড়াল হয়ে গেল তখন বিড়বিড় করে বললো, বাচ্চাই বটে।
.
এখানে ওর কাজ বলতে তেমন কিছুই নেই। দুই বেলা দুটো আলুতে চালে ফুটিয়ে খাওয়া, সেটাও মাঝে মাঝে করতে হয় না শ্যামলীদের বাড়ি থেকেই আসে। আর স্কুলে বাচ্চাদের পড়ানো। বাকিটা সময় বই পড়া ছাড়া আর কোনো কাজ থাকে না। গ্রামটা এখনো ভালো করে দেখা হয়ে উঠেনি। ছোট থেকেই শহরে মানুষ হয়েছে, তাই গ্রাম প্রথম প্রথম ভালো না লাগলেও এখন বেশ লাগে। তাছাড়া এখানে আসার পর আরও কয়েক জায়গায় আবেদন করেছে চাকরির জন্য। আগের কাগজগুলো ফিরে এসেছে।
.
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো অনিন্দ্য। কাজ তেমন কিছুই না, একটু গঞ্জে যাবে, তারপর এইদিক সেইদিক ঘুরবে। গঞ্জে থেকে ফিরতে ফিরতে বিকাল হয়ে গেল। ফেরার পথে দেখলো শ্যামলী পুকুর পাড়ে বসে আপন মনে ঢিল ছুঁড়ছে পানিতে।
.
- এখানে কেন? বাবা মা ফিরে আসেনি?
- না রাতে আসবে।
এক মনে অানমনা হয়ে ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে জবাব দেয় মেয়েটা। হয়তো মন খারাপ, অনিন্দ্য আর কথা বাড়ায় না। সাইকেলে চেপে বসতে যাবে এমন সময় শ্যামলী বললো,
- মাষ্টার মশাই, আমার মন খারাপ সেটা কী বোঝা যাচ্ছে?
-হ্যাঁ কেন?
কথাটা শুনেই লাফ দিয়ে উঠলো শ্যামলী। তারপর বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো,
.
- সত্যি তো?
- হ্যাঁ, মন খারাপ থাকলে তো বোঝা যাবেই।
.
- না ভাবলাম বোঝা যাচ্ছে না। সেইদিন বাঁধন বললো আমার নাকি মন নেই, তাই আমি মন খারাপ করলে বোঝা যায় না। যাই ওকে একটা উচিৎ শিক্ষা দিয়ে আসি। বলে কিনা আমার মন নেই।
.
কথাগুলো শুনে বেশ অবাকই হলো অনিন্দ্য। মন খারাপ দেখাতে হয় নাকি কাউকে? প্রশ্ন করলো,
.
- বাঁধন কে?
.
- কে আবার ঐ যে...
.
কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেল শ্যামলী। তারপর আবার বললো,
- নাহ্ আপনাকে বলা যাবে না।
.
কথাটা বলেই এবার উল্টো দিকে হাটা শুরু করলো ও। অনিন্দ্যও আবার সাইকেলে চেপে বসলো।
.
- মাষ্টার মশাই, শুনুন শুনুন।
.
অনিন্দ্য পিছন ফিরে দেখলে শ্যামলী আবার ওরই দিকে আসছে।
.
- আচ্ছা আমার মন খারাপের কারণ জানতে চাইলেন না কেন?
- কারণ? না মানে...
- আমার হাতে সময় নেই, তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করুন তো।
- তা বলো তোমার মন খারাপের কারণ কী।
- সেই দিন আপনাকে ঢিল মেরেছিলাম না? তখন বাবা বকা দিছে। বলেছে আমি নাকি বড় হয়ে গেছি, আমার আর এইসব করা মানায় না। আচ্ছা আমাকে দেখে বলুন তো আমি কী বড় হয়েছি?
.
অনিন্দ্য অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিলো। ওর যে এর মধ্যে হাসি পায়নি তেমনটা নয়। পেয়েছিলো, কিন্তু চেপে রেখেছিলো।
.
- না তো তুমি মোটেও বড় হওনি। আর আমি সেইদিনের ব্যাপারে রাগ বা মন খারাপ করিনি তো। বাবাকে বলে দিও।
- কি সত্যি? আচ্ছা তাহলে এখনই বলে আসি।
.
কথাটা বলেই বাড়ির দিকে দুই পা এগিয়ে আবার ফিরে আসলো। বললো,
.
- ও, বাবা তো নেই, আসবে সন্ধ্যায়। তখন বলবো, এখন যাই বাঁধনকে একটু জব্দ করে আসি। কিন্তু এখন তো আমার মন ভালো হয়ে গেল। কি করি বলুন তো?
.
মুখটা ভার করেই প্রশ্ন করলো শ্যামলী। অনিন্দ্য কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু বলা হয়ে উঠলো না। তার আগেই শ্যামলী বললো,
.
- গাছে উঠতে পারেন?
- গাছে!
- ওমা গাছ চিনেন না নাকি?
- না তা চিনি, কিন্তু কেন?
- পারেন কিনা সেটা বলুন।
- উঁহু পারি না।
- আমি পারি।
.
শীতটা এবার বেশ চেপেই ধরেছে। সকালে রোদের দেখা মিলে না। দুপুরে একটুখানি মুখ বের করলেও তেজ নেই। বিকাল হতেই কুয়াশায় ঢাকতে শুরু করে চারপাশ। রাতে কেরোসিন বাতির আলোতে বাচ্চাদের খাতা দেখছিলো অনিন্দ্য। বেশ রাত হয়েছে। কিন্তু ঘুম নেই চোখে। এই রাত জাগা অভ্যাসটা বহু কালের তাই ঠিকমত বাদ দেওয়া যায় না। হঠাত করেই দরজায় একটা ঠক ঠক শব্দ হলো। একবার হয়েই শব্দটা মিলিয়ে গেল। একটু পর আবার, তারপর আবার।
.
-কে?
দরজার ওপাশ থেকে মিহি সুরে ভেসে আসলো,
- আমি। বাইরে আসুন মাষ্টার মশাই।
.
শ্যামলী। কিন্তু এত রাতে! বুকটা ধক করে উঠে ওর। একজন যুবতী মেয়ে....... কেউ দেখলে.....। কাঁপাকাঁপা পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। তারপর দরজাটা খুলতেই শ্যামলী ফিসফিস করে বললো,
.
- চলুন
- কোথায়?
- গাছে উঠবো।
- এত রাতে?
- হুমম খেজুরের রস খাবো।
- কিন্তু.....
কথাটা শেষ করতে পারে না অনিন্দ্য। এর মধ্যেই শ্যামলী হাঁটা শুরু করে দিয়েছে।
.
শিশির ভেজা আইল পথ। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেউ নেই বাইরে। কেবল দুর থেকে ক্ষণে ক্ষণে শিয়াল ডেকে উঠছে।
.
- মাষ্টার মশাই, দাড়ান এখানে।
- আর তুমি?
- গাছে উঠবো।
- তুমি!!!
আর কোনো কথা বলে না শ্যামলী। অনিন্দ্য দেখলো, এরই মধ্যে সে গাছে উঠা শুরু করে দিয়েছে। অন্ধকার হলেও একটু আধটু বোঝা যায়। গাছটা খুব বড় নয়, কিন্তু রসের হাড়িটা বেশ বড়ই।
.
- মাষ্টার মশাই নেন খান।
- না, শীত তো
- আরে খান, কিছু হবে না।
.
শ্যামলীর এই কথা কিন্তু রইলো না। ভোরের দিকেই জ্বর আসলো আটঘাট বেঁধে। রাতের আঁধার যতই কাটে, জ্বরের প্রভাবও ততই বাড়ে। জ্বর থেকে উঠতে তিন চার দিন সময় লাগলো। এর মধ্যে শ্যামলী দিনে বেশ কয়েকবার করে লুকিয়ে এসে এসে দেখে যায়। সাথে খাবার আনে, আর না আনলে নিজের রান্না করে দিয়ে যায়। শ্যামলীর বাবা যে লক্ষ্য করেনি তা নয়, কিছু বলে না।
.
তারপর বেশ কয়েকমাস কেটে গেছে। শ্যামলীর সাথে অনিন্দ্যের একটা ভাবও হয়ে গেছে। অনিন্দ্যের সাইকেলে চেপে ঘুরতে বের হয় ও। দিনে লোকে দেখবে তাই রাতে। একদিন দুপুর বেলা পোষ্ট মাষ্টার একটা চিঠি দিয়ে গেল। শহরে একটা ভালো স্কুলে শিক্ষকতা করতে চেয়ে একটা আবেদন করেছিলো অনিন্দ্য, সাথে নিজের কাজও পাঠিয়ে দিয়েছিলো। ওরাই ডেকেছে। শুধু ডাকেনি চাকরিটাও হয়ে গেছে। রাতের বেলা শ্যামলীকে জানালো কথাটা। মেয়েটা কোনো কথা বললো না। কেবল ও বলেই উঠে দাড়ালো। তারপর বললো,
- আমি যাই মাষ্টার মশাই।
.
এই প্রথম নিজেকে বড় মনে হচ্ছে শ্যামলীর। মনে হচ্ছে সত্যিই এখন সে আর সেই ছোট্ট শ্যামাটা নেই, ও এখন বুঝতে শিখেছে। বুকটা এখন কেঁপে উঠে কেউ যেতে চাইলে। শুধু বুকই কাঁপে না চোখও কথা বলে, নিজের ভাষাতে।
.
গত দুই তিন দিন ধরেই মেয়ের এমন পরিবর্তনে বাবা বেশ অবাকই হলো। মেয়ে আর বাইরে বের হয় না, ছোটাছুটি করে না। দেখে মনে হচ্ছে কেমন যেন নুইয়ে পড়েছে। ভেতর ভেতর দুমড়ে যাচ্ছে। অনিন্দ্যের বদলে নতুন একজন মাষ্টার মশাই এসেছে স্কুলে, সে কথা অবশ্য শ্যামাকে বলেছিলেন সে নিজেই। কিন্তু কোনোই আগ্রহ দেখালো না। কেবল হুম বলেই চুপ করে থাকলো।
.
সকালের ট্রেন।
অনিন্দ্য নতুন মাষ্টার মশাইকে সব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে। এখন গোছগাছ করতে বাকি। শ্যামলীর সাথে দেখা হয়নি বেশ কয়েকদিন। মেয়েটা আর আসে না, দিনে একবারও আসে না। রাতের খাবার খেয়ে জিনিসপত্রগুলো গোছ করছিলো হঠাৎ দেখলো পিছনে শ্যামলীর বাবা দাঁড়িয়ে আছে।
- একি আপনি কখন আসলেন?
- সকালের ট্রেন?
- হ্যাঁ ছয়টায়। সারাদিন তো আর ট্রেন নেই। তাই সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়াই ভালো। আপনি কি বলেন?
- মাষ্টার মশাই, তুমি বরং যেও না। জানি যে চাকরিটা পেয়েছে তা বেশ ভালো। তবুও যেও না, আমার একটাই মেয়ে, আমি আর কয়দিন? আমার যা আছে তাতে তোমাদের দুইজনের খুব ভালো বলে যাবে।।
.
কথাটা শুনে বেশ অপ্রস্তুতই হয়ে পড়লো অনিন্দ্য। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। চোখটা আটকে গেল দরজার দিকে, অন্ধকারে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে কেবল মুখটা বাড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে। শ্যামলী? হ্যাঁ শ্যামলীই, ওর হলদে শাড়িটার আঁচলটা অনিন্দ্যর খুব চেনা।
.
________সমাপ্ত
.
.
লেখায়ঃ